ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ৪৬ জন ব্যক্তিদের পরিবারদের সঙ্গে ২০২১ সালের ২৯ শে মে মাস পর্যন্ত ৪৬ জন শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির...
ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ৪৬ জন ব্যক্তিদের পরিবারদের সঙ্গে
২০২১ সালের ২৯ শে মে মাস পর্যন্ত ৪৬ জন শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির সময় পরিবারদের সঙ্গে থাকতে পেরে আজ আমি আপ্লুত! এটা ভাবতেই আমার শিহরণ জাগছে! সত্যিই আমি কোনোদিনও ভাবতেই পারিনি এই কাজ আমি করতে পারবো।
কমল চক্ৰবৰ্তীঃ
সত্যিই আমি কোনোদিনও ভাবতেই পারিনি একটি বড় লড়াই আমি করতে পারবো। আজ আমার শিহরণ জাগছে!
সংখ্যাটা এখন ‘শূন্য’! হ্যাঁ, শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে ডি ভোটারের নোটিশ পাঠানোর পর যাদের একতরফা রায়ে অথবা কোর্টে লড়াই করে হেরে গেছিলেন এবং পরবর্তীতে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই বন্দিরা সবাই মুক্তি পাওয়ার পর আজ সংখ্যাটা দাঁড়ালো শূন্য।
এই বছর মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল চারজনের। সুমন দাস, দিপালী দাস, মণীন্দ্র দাস ও মুন্না মালাকার।
মুন্না মালাকারের পরিবার থাকে হাফলং শহরে। স্ত্রী শিল্পী মালাকারের পক্ষে কোভিডের কারণে শিলচরে আসার সমস্যা হচ্ছিল দু’বছর ধরে লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায়। তার উপর বিশাল আর্থিক খরচ, যা শিল্পীর পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুটো শিশু নিয়ে এবাড়ি সেবাড়িতে কাজ করেই দিন চলে শিল্পীর। সমস্যাটা জানার পর হাফলং এসপি বর্ডার ও শিলচর জেল সুপারের সহায়তায় মুন্না মালাকারকে হাফলং থানায় স্থানান্তরিত করা হয় গত ডিসেম্বর মাসে, ২০২০ সালে। আগামী জুন মাসে মুন্না মালাকার মুক্তি পাবে।
এই বছর মে মাসের দশ তারিখ সুমন দাস, মে মাসের সতেরো তারিখ দিপালী দাস, আর আজ মণীন্দ্র দাস মুক্তি পাওয়ার পর আর কেউ নেই শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে।
মণীন্দ্র দাস। বাড়ি কাটিগড়া, কাছাড় জেলা। বয়স ৬৭ বছর। পরপর দু’বার নোটিশ পেয়েছিলেন শিলচর চার নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে। একই দিনে। নভেম্বর মাসের সাত তারিখ, ২০১৫ সালে । কেস নং : 4th /D/213/15/471 এবং আরেকটি 4th/D/214/15/448. একই ব্যক্তিকে দুটো নোটিশ পাঠানো, এই প্রথম পেলাম তাও আবার একই তারিখে!! ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে কেন এই কম্মটি করলো, মগজে ঢোকেনি! সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, দু’টো কেসের জন্য দু’বার করে হাজিরা ও ডকুমেন্টস চাওয়া হতো ।আমাদের এই আসাম রাজ্যে এধরনের ঘটনাও ঘটে!!
মণীন্দ্র দাসের বাবার নাম রায় চন্দ দাস। গ্রাম – সিদ্ধিপুর, কাটিগড়া। রায়চন্দ দাস মহাশয় ১৯৬৪ সালে ১৫ই মে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার দিঘিরপাড় গ্রামে থাকতেন। রায় চন্দ দাস মহাশয় যখন পাকিস্তান থেকে শিলচর এসেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর। স্ত্রী নমদূর্গার বয়স ২৫ এবং মণীন্দ্র দাসের বয়স চার বছর । ধলাছড়া রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ক্যাম্প থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। নং 1187dtd. 21/6/1964.
রায় চন্দ দাস ছিলেন দিনমজুর। কাছাড় জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কাজকর্ম করে সংসার চালাতেন। সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেন নি। ছেলে মণীন্দ্র দাসের ভোটার তালিকায় প্রথম নাম ওঠে ১৯৯৭ সালে। রায় চন্দ দাস রিলিফ ক্যাম্প থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলেও ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে না পারায়, সমস্যায় পড়লো মণীন্দ্র দাস মহাশয়। আসলে, দেশভাগের বলি হয়ে যারা পরবর্তীতে ভারতে এসে বসবাস করছিলেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে তাঁরা অনেকেই সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি। হয়তো ভেবেছিলেন, “ নিজের দেশে থাকবো, তারজন্য আবার সার্টিফিকেটের কী দরকার!” এই সমস্যা কিন্তু আসামের ক্ষেত্রেই হচ্ছে তা নয়। দেশভাগের পর আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে এসে যারা বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছেন, সে বাঙালি পাঞ্জাবি বা যেকোনো ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ হোক না কেন, তাদের অনেকের কাছেই সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট থাকবে না। অন্য রাজ্যের সংখ্যাটা জানা যাবে যখন সেইরাজ্যে এনআরসি হবে।
যাই হোক, মণীন্দ্র দাস বিভিন্ন কাগজপত্র কোর্টে জমা দিলেও সময়মতো কোর্টে হাজির হতে পারেননি।তার মূল কারণ ছিল, যে আইনজীবী ওনার কেস লড়ছিলেন, সেই আইনজীবীর হঠাৎ মৃত্যু হয়ে যাওয়ায় মণীন্দ্র বাবুর কাছে সেখবর পৌঁছায়নি! অবশেষে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করা হলো মণীন্দ্র দাসকে ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই এবং তারপর শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হলো ২০১৯ সালের মে মাসের আট তারিখ।
দু’বছর শেষ হয়েছিল বেশ কয়েকদিন আগেই। কিন্তু কোভিডের জন্য কাটিগড়া সাব রেজিস্ট্রার অফিস বন্ধ থাকায় জামিনদারের জমির কাগজপত্র পরীক্ষা করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এনিয়ে শিলচর বর্ডার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করায়, তাদের সহায়তায় কিছু সময়ের জন্য অফিস খুলে শেষ পর্যন্ত জমি পরীক্ষার সবুজ সংকেত পাওয়া গেলো গত পড়শু।
শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ২৯ মে' ২০২১ শনিবার মুক্তি পেলেন মণীন্দ্র দাস দুপুর দুটো তিরিশ মিনিটে। জামিনদার ছিলেন কাটিগড়াবাসী নিশিকান্ত দেব মহাশয়।আজ তার ছেলে বীরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস, দুজনেই ছোটখাটো মাছের ব্যবসা করে, এসেছিল তার বাবাকে নিতে। মণীন্দ্র দাসের কেস এখন গৌহাটি হাইকোর্টে চলছে। দেখা যাক কী হয়।
মণীন্দ্র দাস মহাশয় ও তাঁর পরিবার সুস্থ থাকুক , ভালো থাকুক। নিশিকান্ত দেবের মতো মানবিক মানুষেরাও বেঁচে থাকুক।
ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয় সেই ২০১৮ সালের জুন মাসের ১০ তারিখ থেকে। সেদিন প্রথম শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছিল ১০২ বছরের চন্দ্রধর দাস মহাশয়। তারপর থেকে আজঅব্দি অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৯ শে মে মাস পর্যন্ত ৪৬ জন শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির সময় পরিবারদের সঙ্গে থাকতে পেরে আজ আমি আপ্লুত! সংখ্যাটা একবারে শূন্য হয়ে গেলো আজ!! এটা ভাবতেই আমার শিহরণ জাগছে! সত্যিই আমি কোনোদিনও ভাবতেই পারিনি এই কাজ আমি করতে পারবো।
লড়াইয়ের একটি বড় অধ্যায় শেষ হলো।
No comments