রাষ্ট্রহীন বন্দিত্বের জীবন থেকে দয়জান বিবির মুক্ত আকাশ... ---যাদের ধর্ম রাষ্ট্রহীন, যাদের ভাষা রাষ্ট্রহীন, যাদের জাতি রাষ্ট্রহীন, যাদের সভ্য...
রাষ্ট্রহীন বন্দিত্বের জীবন থেকে দয়জান বিবির মুক্ত আকাশ...
---যাদের ধর্ম রাষ্ট্রহীন, যাদের ভাষা রাষ্ট্রহীন, যাদের জাতি রাষ্ট্রহীন, যাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-আশা-আকাঙ্খা সমস্তটাই রাষ্ট্রহীন!
✍️ পারিজাত নন্দ ঘোষ
জানিনা কতটা পথ হাটলে ভারতীয় হওয়া যায়? জানি না অমানবিক প্রসব যন্ত্রণায় জন্ম নেওয়া, অমানবিক ব্যবস্থাপনায় লালন পালন হওয়া এসব অমানবিক ব্যবস্থাপনার অবসান কবে ঘটবে!
এখনো স্বপ্ন দেখি নচিকেতার গানের মতোই "একদিন ঝর থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে"...
সেদিন যেন মুক্ত ভাবে কাজ করা যায় শিক্ষা নিয়ে, সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে, রুচি সম্পন্ন সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে! যে সমাজ ব্যবস্থায় থাকবে শুধু বেঁচে থাকার আনন্দ! থাক এসব মৃতপ্রায় ছিলিং ছোয়া কল্পনার কথা, যে বিষয়টি নিয়ে লেখা সেটা লিখে নেই। ঘটনা দুদিন আগের হলেও সময়ের অভাবে লেখা হয়ে উঠেনি!
দয়জান বিবি,জন্মসুত্রেই অসমের ধুবড়ি জেলার গৌরীপুর থানার অন্তর্গত মধুশোলমারী গ্রামের বাসিন্দা! বিবাহও একই গ্রামে!
বছর দুই আগের কথা,রমজানের প্রথম রোজা ছিলো সেদিন...! স্বামী আব্দুল রেজ্জাক তখন বাজারে, বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ির সামনে প্রচুর লোক! এত ভীড় কেন? কেউ কিছু বলে না! সবাই মৌন! তাকিয়ে আছে সবাই রেজ্জাকের দিকে...! লোকের এমন অদ্ভুত তাকানো দেখে রেজ্জাক বুঝে গিয়েছিলো কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে তা ঠিক বুঝেনি!
সাইকেল থেকে নামতেই ঘরের ভিতর থেকে ছোটো ছেলে হাউ হাউ করে কান্না করে জড়িয়ে ধরে তাকে! রেজ্জাক বাবু ঠিক তখনো বুঝেনি আসল ব্যাপারটা কি! কেনই বা এত লোক,কেন এত ভীড়!
"আব্বা,মাক ধরি নিয়া গেছে"বলে যখন ছোটো মেয়ে মাটিতে গরাগরি, তখন আর আব্দুল রেজ্জাকের বুঝার বাকি থাকলো না...!
এদিকে দয়জান বিবির যখন অচেতন থেকে সচেতন অবস্থায় আসেন তখন বিকেল! তার আগে এতটুকুন তার মনে আছে যে তার হাতের ছাপ নেওয়া হয়েছে! সে চিৎকার করছিলো আর কয়েকজন মহিলা পুলিশ তাকে গাড়িতে টেনে উঠিয়েছিলো! যখন চেতন হয় তখন যায়গাটা ছিলো কোকরাঝার কোর্টের ঠিক আগের একটি ফলের দোকানে সামনে দয়জান,আর তার পাশে মহিলা ও পুরুষ পুলিশ গিজগিজ করছে! তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলো যে সে রোজা না কি? সে কিছু বলার আগেই তার চোখ ঘোলা হয়ে আসে আবার অচেতন! রাতে আর কিছুই জানেনা দয়জান! ভোরে যখন জাগে দেখে মাটিতে শুয়ে আছে,গায়ে দেওয়া আছে এক কালো কম্বল! শরীর জ্বর জ্বর,মাথা ব্যাথা...! প্রেসাব করতে গিয়ে পরে যায়, পায়ে চোট পায়, বার বার অচেতন হয়ে যায়, মেডিকেলও নেওয়া তাকে কিন্তু ঘরে আর আসা হয়না! দিনটা তো যেমন তেমন,সূর্য অস্ত যাবার না খাওয়া না কোনো আলো, কোনো অপরাধ না করেই তাকে বন্দিত্বের জীবন কাটাতে হয়! এভাবেই কেটে গেলো ২ বছর ২১ দিন! ধুবুড়ীর ব্রহ্মপুত্র আর কোকরাঝারের গৌরাঙ্গ দিয়ে এই দুই বছর বহু জল প্রবাহিত হয়েছে!
যারা ভারতীয় হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করে নিঃশর্ত মুক্ত হলো তাদের তো সমস্যা নেই, তবে জামিন শর্তে মুক্ত হওয়াদের ক্ষেত্রে সাময়িক একটা ভালো দিক হলেও ন্যায়ের জন্য হাঁটতে হবে বহুও আর পথ! এই পথ অতি জটিল ও পংকিল...!
স্বামীর অসুস্থতা, অপারেশন! তিন ছেলে মেয়েরই শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি! ছোটো মেয়েকে গ্রামেরা লোকেরা বিয়ে দিয়ে দেওয়া! বড় ছেলে সে বছরই তো মেট্রিক পাশ করেছিলো,মার অবর্তমানে প্রথমে মানসিক ভাবে অস্থীরতা,পরবর্তী সময়ে বেঙ্গোলর কাজে চলে যাওয়া! ছোটো ছেলে মার অনুপস্থিতি, বাবার অসুস্থতা সব কিছু মিলিয়ে এক দিশাহীন যুবক,অষ্টম শ্রেণিতেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যবনিকা!
দয়জান নিজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না করলেও তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করবে এমনটা স্বপ্ন ছিলো সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার পুরা কপালে!
তারপর?
" তুই এত নিষ্ঠুর কেমন করি হলু? " ২ বছর ২১ দিন পর বাড়ি এসে এমনটাই অভিযোগ প্রতিবেশী মহিলাদের কাছে দয়জানের! প্রতিদিন প্রতিরার কাঁদতো সে, আশায় থাকতো তার প্রতিবেশী-বান্ধবী-আত্মীয়রা যাবে আর তার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তার মনের কথা শুনবে...!
না সব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে!
তার থাকতে হয়েছে অমলা দাস, শান্তি বাছফোর, সোনা ভানু দের সাথে! যারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রহীন!
যাদের ধর্ম রাষ্ট্রহীন, যাদের ভাষা রাষ্ট্রহীন, যাদের জাতি রাষ্ট্রহীন, যাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-আশা-আকাঙ্খা সমস্তটাই রাষ্ট্রহীন!
"বহুত দৌড়াদৌড়ি কচ্ছি,কাম হৈ নাই, গরীব মানুষ ভাই,কামলা দিয়া খাই! আল্লার কাছত প্রত্যেক দিন দুয়া করসং কাকো যাতে পাঠাই...!"
"তুমার দুজনক পাঠাইছে আল্লা! ইয়ারনআগত অফিসত পাত্তাই দেই নাই,তুমরা আসার পর সে কামগুলা হওয়া হৈছে!" আামকে ও সহযোদ্ধা ভাতৃপ্রতিম হাবিবুল কে উদ্দেশ্য করে এমনটাই বক্তব্য দয়জান বিবির সহজ সরল ভাইয়ের!
নথী আছে, আর্থ-সামাজিক ও শৈক্ষিক ভাবে পশ্চাৎপদ, বহু অধিবক্তার খামখেয়ালি, ট্রাইবুনালের বিভিন্ন জটিলতা, একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন কারকে কাজ করে এসব ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে!
সিজেপির হাত ধরে দয়জান বিবি ডিটেনশন মুক্ত করে নিয়ে আসার পর আামদের চোখের সামনেই কতবার যে সেন্সলেস হলো তার হিসাব নেই! মানসিক ও শারীরিক উভয় দিকে ভেঙ্গে গিয়েছে দয়জান, যেমন স্বভাবিক ভাবে হয় বাকি মহিলা ডিটেইনিরা ও বহু পুরুষ ডিটেইনিরাও!
রাত তখন অনেকটা, সবাই ই আমরা ক্লান্ত ছিলাম! দুই-তিন জেলা অতিক্রম করে আসার সম্ভবনাও ছিলো বহু জটিল! সতীর্থ পাপিয়া বউদির সুবাদে তার গৌরীপুর স্থিত বাবার বাড়িতে রাতের খাবার ও সুবার ব্যবস্থা হয়ে গেলো! পরদিন অর্থা গতকাল আরও কিছু কাজ ছিলো ধুবড়িতে,সেরে বাড়ি ফিরলাম...
যারা ভারতীয় হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করে নিঃশর্ত মুক্ত হলো তাদের তো সমস্যা নেই, তবে জামিন শর্তে মুক্ত হওয়াদের ক্ষেত্রে সাময়িক একটা ভালো দিক হলেও ন্যায়ের জন্য হাঁটতে হবে বহুও আর পথ! এই পথ অতি জটিল ও পংকিল...! এই যাত্রায় পাশে ছিলাম,আছি ও থাকবো, দরকার সকলের সহযোগিতার! ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার! যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতেই হবে! অধিকারের কোনো লড়াইয়েই পিছু হাটার প্রশ্ন উঠে না!
অধিকার ফিরে পাক দয়জান বিবি -অমলা দাসেরা! ভালো থাকুক সকলে...!
--------
[অনুসন্ধানমূলক-স্বতন্ত্ৰ-মুক্ত সাংবাদিকতাৰ যাত্ৰা অব্যাহত ৰাখিবলৈ versatilestory.com-ক প্ৰয়োজন আপোনাৰ সহযোগিতা, পৰামৰ্শ আৰু আৰ্থিক সহায়ৰ। আমাৰ যাত্ৰাক সহায় কৰিবলৈ মবাইল নম্বৰ ৮৬৩৮৬৯৮৪৫০-ত যোগাযোগ কৰক। আপুনি যি কোনো পৰামৰ্শ বা যি কোনো পৰিমানৰ আৰ্থিক বৰঙণি আগবঢ়াব পাৰে। ]
No comments