পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে এনআরসি হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে গরিব নিরক্ষর বিবাহিতা মহিলারা ---আসামের এনআরসি’তে বহু গরিব মহিলার নাম আসেনি...
পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে এনআরসি হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে গরিব নিরক্ষর বিবাহিতা মহিলারা
---আসামের এনআরসি’তে বহু গরিব মহিলার নাম আসেনি! অনেক বিবাহিতা মহিলারা ওদের বাবার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো সরকারি নথিপত্র দেখাতে পারেনি আসামের এনআরসি’তে। ওদের যে কী হাল হবে, একমাত্র ঈশ্বর-ই জানে!
কমল চক্রবর্তী:
দিপালী দাস। স্বামীর নাম অভিমন্যু দাস। বয়স ৫৬ বছর। বর্তমান থাকে শিলচর আশ্রম রোডের রামগড় গ্রামে। ছেলেমেয়ে নিয়ে মোট সাতজনের সংসার। এক ছেলে ও দুই মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে বেসরকারি অফিসে কাজ করে। ওদের রোজগারের কিছু টাকায় সংসার চলে। বড় মেয়ে অর্পিতা সংসারে সাহায্য করার জন্য টিউশন করে থাকে। বাবার শরীরও ভালো থাকে না। মাঝেমধ্যেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যান।
আমার সঙ্গে যোগাযোগ একমাত্র অর্পিতার সঙ্গে। মা শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাতে পরিবার চালানো স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের ওপর বিশাল চাপ একা অর্পিতাকেই সামাল দিতে হয়।
গত এপ্রিল মাসের দুই তারিখ,২০২১ সালেই অর্পিতাকে সঙ্গে নিয়ে ওর মা দিপালী দাসের সঙ্গে প্রথম ডিটেনশন ক্যাম্পে দেখা। মে মাসে দিপালী দাসের মুক্তির কথা বলতেই, বললেন, “আমার এই মেয়েটি ভীষন একা হয়ে গেছে। ওকে একটু সাহায্য করুন দাদা।“ বললাম, একমাস অপেক্ষা করুন।
দিপালী দাস। বাবার নাম প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র দাস। শিলচর ৬ নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে নোটিশ যায় ২০১৭ সালের দশ অক্টোবর। তখন দিপালী দাস থাকতেন সিংগুয়া গ্রামে,লালছড়া। পোষ্ট অফিস- ধলাই।কাছাড় জেলা।
দিপালী দাসের জন্ম ১৯৬৬ সালের তিন ডিসেম্বর। বাবা প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র দাসের ১৯৬৫ সালের ভোটার তালিকায় নামও আছে। সেই সময় ওর বাবা থাকতেন কাতিড়াইল গ্রামে। কাটিগড়া, কাছাড় জেলা। দিপালী দাসের কাছে ভোটার কার্ড – প্যান কার্ড সব-ই আছে। কিন্তু কী নেই ? নেই তার মা – বাবার সঙ্গে সম্পর্কের নথিপত্র। অর্থাৎ জন্মের সার্টিফিকেট বা স্কুল সার্টিফিকেট। আসামে জন্মের সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। দিপালীর জন্ম এর আগে। গরিব মানুষের সবার কপালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। কাজেই শুধুমাত্র প্যান কার্ডের ভিত্তিতে ( যেখানে ওর বাবার নাম ছিল), আসামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল মারফত ভারতীয় প্রমাণ করা খুব মুশকিল! ঠিক একই কারণে আসামের এনআরসি’তে বহু গরিব মহিলার নাম আসেনি! অনেক বিবাহিতা মহিলারা ওদের বাবার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো সরকারি নথিপত্র দেখাতে পারেনি আসামের এনআরসি’তে। ওদের যে কী হাল হবে, একমাত্র ঈশ্বর-ই জানে!!
জামিনদাররা কথা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে না পারায় সমস্যায় পড়লো অর্পিতা। এরমধ্যে ব্যাঙ্গালোরে ভাইবোন দু’জনের কোভিড পজিটিভ। কান্নায় ভেঙে পড়লো অর্পিতা! বললো, “এখন থাকুক। আমার কাছে টাকা নেই। ব্যাঙ্গালোরে ভাই – বোনের কাছেই টাকা পাঠাতে হবে চিকিৎসার জন্য। মা-কে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বের করার মতো টাকা আমার কাছে নেই!” বললাম, অর্পিতা হাল ছেড়ো না। তোমার মা’কে কথা দিয়ে এসেছি ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেবোই
এদিকে খুব কম বয়সেই মা – বাবা দুজনকেই হারিয়ে বিপদে পড়ে গেলো দিপালী। সাত বছর বয়সে মা’কে এবং চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা’কে !! শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে পাঁচ ফেব্রুয়ারি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে Order বের হলো, “ She is an illegal migrant of post 25/03/1971 stream. So, O.P has no right to live within the territory of India and send back from India within an early date.” এখানে O.P মানে opposite party অর্থাৎ দিপালী দাস। সেই অর্ডারের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের মে মাসের পাঁচ তারিখ আশ্রয় হয় শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে। তার ডিটেনশন ক্যাম্পে দুবছর পূর্ণ হয়েছিলো এই মাসের পাঁচ তারিখ। সেদিনই ওর বেরিয়ে যাওয়ার কথা। জামিনদাররা কথা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে না পারায় সমস্যায় পড়লো অর্পিতা। এরমধ্যে ব্যাঙ্গালোরে ভাইবোন দু’জনের কোভিড পজিটিভ। কান্নায় ভেঙে পড়লো অর্পিতা! বললো, “এখন থাকুক। আমার কাছে টাকা নেই। ব্যাঙ্গালোরে ভাই – বোনের কাছেই টাকা পাঠাতে হবে চিকিৎসার জন্য। মা-কে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বের করার মতো টাকা আমার কাছে নেই!” বললাম, অর্পিতা হাল ছেড়ো না। তোমার মা’কে কথা দিয়ে এসেছি ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেবোই।“
জামিনদারের খোঁজে বেড়িয়ে পড়লাম। নিজের ফ্ল্যাটের কাগজপত্র দেখানোর পর আইনজীবী বললেন, হবে না। এরপর বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আবেদন জানানোর পর হতাশ হলাম!!
অবশেষে নিজেরই সংগঠন শিলচর “বীক্ষণ সিনে কমিউন”- এর একনিষ্ঠ কর্মী মলয় দাস এগিয়ে এসে নিজেই জামিনদার হলো। অর্পিতাকে জানানোর পর, আরেকজন জামিনদার জোগাড় করতে ছুটলো অর্পিতা। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। কিন্তু, বর্তমান গৌহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে একজন জামিনদার হলেই চলবে।
সোমবার, ১৭ মে', ২০২১। জামিনে মুক্তি পেলো দিপালী দাস। আজ খুব খুশি অর্পিতা সহ তার মা বাবা ও ভাইবোনেরা।
আন্তরিক অভিনন্দন মলয় দাস-কে। বেঁচে থাকুক মানবতা । বেঁচে থাকুক মলয় –দের মতো মানবিক ব্যক্তিরা। তার এই আন্তরিক সহযোগিতা সমাজ মনে রাখবে।
[পুনশ্চ --- “পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে এনআরসি হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে গরিব নিরক্ষর বিবাহিতা মহিলারা! তারা কোনোভাবেই বিয়ের আগে বাবার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো সরকারি নথিপত্র দেখাতে পারবে না, তার কারণ তাদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ! তাদের কাছে জন্মের সার্টিফিকেট থাকে না এবং তারা স্কুলমুখি হয় না । দিপালী দাসের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল!!”]
No comments